শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১০:১৫ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মুসলমানদের জন্য অতি জরুরি বিষয় হলো, সাধারণ মানুষসহ সৃষ্টি জগতে যা কিছু রয়েছে সব কিছুর সঙ্গে আদব রক্ষা করে চলা। আদব অর্থ বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা ইত্যাদি। মুসলিম জীবনে আদব-কায়দার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদব রক্ষা করা জরুরি।
দুনিয়ার নিয়মে প্রতিদিন আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নানা ধরনের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। এ সময় আমাদের আচার-আচরণ আসলে কেমন হওয়া উচিত। বিজ্ঞজনদের সাধারণ সূত্র হলো, মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হবে, বয়সে যারা বড় তাদের মান্য করতে হবে এবং যে কোনো মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সে লক্ষ্যে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই বড়দের শ্রদ্ধা করতে শেখাতে হবে। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অর্থ নিজের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা। শৈশবে যে শিষ্টাচার শেখে না, পরিণত বয়সেও তার কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় না। অনেকে অহংকারের কারণে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে পারে না, মনে করে বড়দের সম্মান দিলে সে ছোট হয়ে যাবে। কিন্তু সে বুঝতে চেষ্টা করে না, অন্যকে মর্যাদা দিলে নিজের মর্যাদা বাড়ে। অন্যকে সম্মান দেওয়ার মানে নিজে ছোট হয়ে যাওয়া নয়।
বর্তমান সমাজে নানা কারণে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। ফলে সমাজে শ্রদ্ধাবোধের ব্যাপক অবনতি হচ্ছে। তবে যারা বড়, তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে ছোটদের আদর-সোহাগে শিষ্টাচার শেখানোর বিষয়ে। আপনি ছোটদের সালাম দিতে শুরু করুন, দেখবেন তারা এরপর থেকে আপনার আগেই সালাম দেওয়ার চেষ্টা শুরু করবে।
বলা হয়েছে, যে আগে সালাম দেবে সে বেশি সওয়াব পাবে। ছোটরা আমাকে শ্রদ্ধা করছে না সে জন্য তাদের অপরাধী ভাবলে চলবে না। তাদের কাছে টেনে কাছে আনতে হবে। স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে শ্রদ্ধার যোগ্য করে তুলতে হবে। শ্রদ্ধার যোগ্যতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন কথা বলার ধরন, চলাফেরা, আচার-আচরণ ছোটদের কাছে অনুকরণীয় হয়। তারা যেটা জানে না, বোঝে না, সেটা তাদের জানাতে ও বোঝাতে হবে। তাদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে তাদের ভদ্র মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ দায়িত্ব পালন না করে, নতুন প্রজন্ম গোল্লায় যাচ্ছে, বর্তমানের ছেলেমেয়েরা ভদ্রতা জানে না, বড়দের সম্মান করে না এ জাতীয় শ্লেষাত্মক কথা কাম্য নয়।
শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। প্রথম সাক্ষাতে আপনি একজন মানুষকে ভালো বা মন্দ হিসেবে বিচার করেন মূলত ওই ব্যক্তির আচরণ দেখে। আর ভালো আচরণের বৈশিষ্ট্য হলো সংযম ও বিনয়। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যে কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। এমন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করে, হোক সে ব্যক্তি অসুন্দর কিংবা গরিব। পৃথিবীতে যারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। প্রত্যেক ধর্মেই আদব ও শিষ্টাচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোটা মানবজাতির জন্য আদর্শ। তিনি নিজের আচার-আচরণের মাধ্যমে সবার জন্য শিষ্টাচারের শিক্ষা রেখে গেছেন। তিনি এতটাই বিনয়ী ছিলেন যে, ছোট-বড় সবাই তাকে পছন্দ করত। সংযম, বিনয়, ভদ্রতা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কখনো তিনি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি, উদ্ধত আচরণ করেননি। এ কারণেই যুগে যুগে মানুষের কাছে তিনি এত শ্রদ্ধার পাত্র, বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শ।
বলা হয়, শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবারের বড়রা যেমন ব্যবহার করে শিশুরা তাই অনুকরণ করে। বাল্যকালে শিশুদের সংযম, বিনয় ও উন্নত রুচির চর্চা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার গড়ে তোলে। তাই কম বয়স থেকেই শিশুকে শিষ্টাচার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, এর ফলে শিশুর মনে তা গেঁথে যাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে ভদ্র আচরণ করবে। যেসব শিশু শিষ্টাচার মেনে চলে না, তারা বড়দের কাছে যেমন খুব একটা পাত্তা পায় না তেমনি সমবয়সীদের কাছেও অপ্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। এর ফলে শিশুকাল থেকেই ভদ্র হিসেবে গড়ে ওঠা জরুরি।
তবে ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের শিক্ষা এক রাতে সম্ভব নয়। আর শিশুর কাছে আপনার প্রত্যাশা হতে হবে তার বয়স অনুযায়ী। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক, পিতা-মাতা, শিক্ষক থেকে শুরু করে সবার আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সর্বাগ্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা লক্ষণীয়। সন্তানরা বাবা-মায়ের আচরণ দেখে শেখে। আপনি যদি কাউকে গালি দেন তাহলে সে অবলীলায় তা শিখে নেবে এবং সুযোগ পেলে আপনাকে অথবা তার খেলার সাথী কিংবা সহপাঠীকে গালি দিয়ে বসবে। অতএব শিশুকে শিষ্টাচার শেখানোর জন্য সময় ব্যয় করতে হবে, সন্তানকে ভালো কিছু না শিখিয়ে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করার মানে হয় না।
শিষ্টাচারজনিত ঘাটতির কারণে মানুষ তুলনামূলক দরিদ্র শ্রেণি-পেশার লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। অল্পতেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে যায়। এ জন্য পাঠ্যসূচিতে গুরুত্বসহকারে শিষ্টাচার অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ভদ্রতা ও কথা বলার ধরন শেখানো উচিত। কারণ মানুষের মধ্যে এসবের ঘাটতি থাকলে অনেক ভালো গুণ ম্লান হয়ে যায়। এ বিষয়গুলো ছোটবেলায় যদি বাচ্চাদের মনে গেঁথে দেওয়া যায়, তারা সারা জীবন তা মনে রাখবে এবং ওইভাবে চলার চেষ্টা করবে।
ইসলামি স্কলারদের মতে, ‘শিষ্টাচার মেনে চলার ক্ষেত্রে অন্যের অনুভূতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি।’ অর্থাৎ আপনাকে অন্যদের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে হবে। অন্যেরা যে আপনার আচরণে কষ্ট পেতে পারে অথবা আপনার আচরণের কারণে ভালো কিছু হতে পারে, তা বুঝতে হবে।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) বলেন, আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন করো। সাহাবি হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তুমি আদব অন্বেষণ করো, কারণ আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক। ব্যক্তিত্বের দলিল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ/সুত্র: দেশরূপান্তর